
অষ্টাবক্র গীতা ও স্ট্রিং থিওরি: আত্মা ও মহাবিশ্বের একত্বের বিজ্ঞান ।
মহর্ষি অষ্টাবক্রের বাণী: জ্ঞান ও বিজ্ঞানের মহামিলন ।
মানব ইতিহাসে কিছু জ্ঞান এমন গভীর ও মৌলিক, যা স্থান-কালকে অতিক্রম করে যায়। অষ্টাবক্র গীতা সেই অদ্বৈত জ্ঞানের মূর্ত প্রকাশ। অষ্টাবক্র মুনি কোনো সাধারণ ধর্মপ্রচারক ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক মহর্ষি, যাঁর জ্ঞান আত্মতত্ত্বের গভীরতম স্তর থেকে উৎসারিত। তিনি রাজা জনককে যে জ্ঞান দান করেছিলেন, তা হাজার বছর পর আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে উন্নত তত্ত্ব—'স্ট্রিং থিওরি'—এর মধ্যে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
অষ্টাবক্রের বাণী ছিল সুদৃঢ়: তুমি দেহ নও, তুমি মন নও, তুমি কার্যকারণ-শৃঙ্খলের অধীন নও—তুমি সেই চৈতন্য, যা আদি, অন্তহীন ও চিরমুক্ত।
এই কথাই অদ্বৈত বেদান্তের নির্যাস: "সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম"—এই জগতের সবকিছুই সেই একক ব্রহ্ম। এই জ্ঞান মহর্ষি অষ্টাবক্রের সেই গভীরতম উপলব্ধি এবং আধুনিক বিজ্ঞানের 'একক শক্তির' ধারণার মধ্যেকার অবিশ্বাস্য ঐক্যের উপর আলোকপাত করে।
১. কর্মফল ও কর্তা-ধারণার বিলুপ্তি: কার্যকারণ-শৃঙ্খল ও সাক্ষী আত্মা ।
অষ্টাবক্র গীতার মূল ভিত্তি হলো—'কর্তা' বা 'ভোগী' বলে কোনো সত্তার অস্তিত্ব নেই। অজ্ঞানতার কারণেই মানুষ নিজেকে কর্মের ফলদাতা বা ফলভোগী মনে করে।
অষ্টাবক্রের বাণী: “প্রকৃতির নিয়মে সব কর্ম ঘটে; আত্মা কেবল সাক্ষী, তিনি নিষ্ক্রিয় ও মুক্ত।”
যখনই কেউ মনে করে ‘আমি করি’, তখনই সে কর্মফলের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে। কিন্তু আত্মজ্ঞান লাভ হলে এই 'আমি' বা কর্তা-ভাবনা বিলীন হয়ে যায়। আত্মা কেবল দেখছে, যেমন আকাশে মেঘ আসে যায়, কিন্তু আকাশ তাতে স্পর্শিত হয় না।
আধুনিক বিজ্ঞানের যুক্তি:
পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, মহাবিশ্বের প্রতিটি ঘটনা কারণ-কার্যের অনিবার্য শৃঙ্খলে বাঁধা। নিউটনের সূত্র বা কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের সমীকরণগুলি প্রমাণ করে যে, প্রতিটি ভৌত ঘটনা প্রকৃতির পূর্বনির্ধারিত সূত্র মেনেই ঘটে। এখানে ব্যক্তিগত 'কর্তৃত্ব' বা 'ইচ্ছা'র কোনো স্থান নেই—প্রকৃতি নিজেই এক স্বয়ংক্রিয়, স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রক্রিয়া। এই বৈজ্ঞানিক সত্য অষ্টাবক্রের সেই উপলব্ধিকে শক্তিশালী করে: কর্ম হচ্ছে প্রকৃতির নিয়মে, আর আত্মা সেই বিধির সাক্ষীমাত্র।
২. পাপ-পুণ্য ও স্বর্গ-নরক: মুক্তি বলে কিছু নেই, কারণ আত্মা চিরমুক্ত ।
এখানেই মহর্ষি অষ্টাবক্রের জ্ঞান সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায়। তিনি ঘোষণা করেন যে, মুক্তি বলে কিছু নেই, কারণ আত্মা কখনও আবদ্ধ ছিলই না। পাপ, পুণ্য, স্বর্গ, নরক—এই ধারণাগুলির কোনো অর্থই থাকে না, কারণ আত্মা স্বয়ং ব্রহ্ম এবং সে সর্বত্র মুক্ত, নিস্তরঙ্গ এবং অনন্ত।
অষ্টাবক্রের গভীরতম উপলব্ধি: “যিনি জানেন আত্মা, তাঁর কাছে পাপ নেই, পুণ্যও নেই। তাঁর জন্য স্বর্গও নেই, নরকও নেই, এমনকি 'মুক্তি' বলেও কিছু নেই। যিনি চিরমুক্ত, তাঁর আবার কিসের মুক্তি?”
পাপ-পুণ্য হলো কেবল মনের দ্বৈত চিন্তার প্রক্ষেপণ। এই দ্বৈততা তখনই তৈরি হয়, যখন মানুষ নিজেকে দেহ ও মন মনে করে। যখন মন লয় পায়, তখন ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ সবই এক সমত্বে বিলীন হয়ে যায়। স্বর্গ ও নরক হলো কেবলমাত্র মনের তৈরি কল্পিত অবস্থা—এক 'মানসিক প্রক্ষেপণ', যেমন ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্ন। আত্মজ্ঞানীর কাছে এই সকল ধারণা তাই তুচ্ছ।
৩. প্রকৃতি ও ঈশ্বর: এক সর্বব্যাপী চেতনার বিজ্ঞান ।
অষ্টাবক্র গীতার মতে, ঈশ্বর কোনো ব্যক্তি নন, বা কোনো স্থানের অধিপতিও নন। তিনি হলেন সেই সর্বব্যাপী, নিরাকার, মৌলিক চৈতন্য, যিনি প্রতিটি কণা ও প্রতিটি ঘটনার মূলে বিদ্যমান। এই চৈতন্যই হলো সেই ‘ঐশ্বরিক বিধি’ বা ‘Natural Law’, যা বিজ্ঞানের নিয়মের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে।
অষ্টাবক্রের ঘোষণা: “যা কিছু ঘটছে, সবই সেই চেতনার স্বাভাবিক প্রকাশ। এতে ব্যক্তিগত কর্তা বা ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে কিছু নেই—আছে শুধু 'নিয়ম'।”
স্ট্রিং থিওরির একত্ব:
স্ট্রিং থিওরি এই ধারণার আধুনিক গাণিতিক প্রমাণ দেয়। এই তত্ত্ব অনুসারে:
একক উৎস: মহাবিশ্বের ক্ষুদ্রতম কণাগুলি (কোয়ার্ক, ইলেকট্রন) আসলে একক, অতি-ক্ষুদ্র, কম্পনশীল তন্তু (String) দিয়ে গঠিত।
সমন্বয়: একই তন্তুর ভিন্ন ভিন্ন কম্পাঙ্ক (frequency) তৈরি করে ভিন্ন ভিন্ন কণা, ভিন্ন ভিন্ন শক্তি এবং ভিন্ন ভিন্ন রূপ।
মহাবিশ্ব এক স্পন্দন: এই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হলো একই মৌলিক কম্পনের বৈচিত্র্যময় প্রকাশ।
ঐক্য: এখানে স্ট্রিং থিওরির একক মৌলিক শক্তি বা তন্তু অষ্টাবক্রের ব্রহ্মচেতনা বা নিরাকার ব্রহ্ম-এর সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। ব্রহ্ম হলো সেই স্থির পটভূমি, যার মধ্যে শক্তি কম্পিত হয়ে বিশ্ব সৃষ্টি করছে।
৪. আত্মা ও ব্রহ্মাণ্ড: একই সত্যের দুই দিক ।
অষ্টাবক্রের জ্ঞান এবং স্ট্রিং থিওরির বিজ্ঞান একই উপসংহারে পৌঁছায়: দ্বৈত নেই, বিভাজন নেই—আছে কেবল এক সর্বব্যাপী সত্তা বা চেতনা।
ঋষির বাণী: “আমি চৈতন্য, আমি নিস্তরঙ্গ, আমি অনন্ত। আমার মধ্যে জন্ম-মৃত্যু বা কর্মের কোনো দাগ পড়ে না।”
বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা: “সবকিছুই চেতনার কম্পন। আত্মা সেই স্থির, নিস্তরঙ্গ সত্তা, যার মধ্যে এই সব কম্পন ও তরঙ্গ ওঠে।”
এই উপলব্ধিতে ধর্ম, জাতি, আচার, কর্মফল—সব ধারণাই বিলুপ্ত হয়ে যায়। মানুষ যখন এই চেতনার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম বলে উপলব্ধি করে, তখন সে স্বয়ং ব্রহ্ম হয়ে যায়। সে জানতে পারে—
“আমি যা, তা-ই সমগ্র বিশ্ব। আমি যা দেখি, তা-ই আমি।”
মহর্ষি অষ্টাবক্রের বাণী শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় শিক্ষা নয়, এটি মহাবিশ্বের গভীরতম বিজ্ঞান। এই জ্ঞান বলে যে, তোমার বন্ধন একটি ভ্রান্তি মাত্র; তুমি আদিতেও মুক্ত ছিলে, বর্তমানেও মুক্ত আছো এবং ভবিষ্যতেও মুক্ত থাকবে। এই বোধই হলো প্রকৃত জীবন্মুক্তি—জীবিত অবস্থাতেই সব মানসিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তি।
একদিকে আধ্যাত্মিক ঋষি ঘোষণা করছেন "সবই ব্রহ্ম," অন্যদিকে বিজ্ঞানী গাণিতিকভাবে প্রমাণ করছেন "সবই কম্পন।" এই দুইয়ের মিলন মানবচেতনাকে এক নতুন স্তরে উন্নীত করে।
অষ্টাবক্র গীতার চূড়ান্ত বার্তা হলো:
The Universe is Consciousness in Motion, and You are that Consciousness.